আজীবন শুধু রূপকথার গল্পতেই দেখেছি যেখানে একটি রাজ্যের প্রজাদের সমৃদ্ধি, সুখ ও শান্তির পরিমান বুঝানোর জন্য উপমা হিসেবে বলা হতো যে অমুক রাজ্যে প্রজারা এতটাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো যে তাদের ঘরের দরজা খোলা রেখেই তারা ঘুমোতে যেতো। এই উপমার বাস্তব রূপ আমি দেখেছি আইসল্যান্ডে। আইসল্যান্ডে সত্যিকার অর্থেই মানুষদের দেখেছি ঘরের দরজা সারা রাত খোলা রেখে ঘুমোতে যেতে।

আইসল্যান্ডে আমরা রিং রোড পুরোটা ড্রাইভ করার সুবাদে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি এবং থেকেছি বিভিন্ন গ্রামে। দুটি রাত কাটিয়েছি গাড়িতে, এক রাত কাটিয়েছি হোটেলে আর বাকি ৪ রাত কাটিয়েছি গেস্ট হাউজে। গেস্ট হাউজ গুলো হচ্ছে আইসল্যান্ডিক দের বাসা-ঘর যেগুলোর একটি অংশ তারা ট্যুরিষ্ট দের ভাড়া দিয়ে থাকে বিশেষ করে সামার সিজনে। কারো হয়তো ৪ বেডরুমের বাসা রয়েছে সেক্ষেত্রে ২ বেডরুম তারা ব্যবহার করে আর বাকি ২ রুম তারা ভাড়া দিয়ে থাকে ট্যুরিস্ট দের কাছে। এর মাধ্যমে কিছু বাড়তি ইনকাম হলো।
প্রথম যেদিন এই ধরণের একটি গেস্ট হাউজে যাই তখন বাজে রাত ১১:৩০ এর মত। নিজের কাছে লজ্জিত লাগছিলো যে এতো রাতে গিয়ে বাসার মালিক কে বিরক্ত করবো ?চিন্তা করছিলাম আরও আগেই আসার প্রয়োজন ছিল। বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করলাম। দরজা বন্ধ করা। কি করবো চিন্তা করছিলাম। এতো রাতে মালিক কে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করবো ? কি করবো চিন্তা করতে করতে দরজার সামনে গিয়ে দরজাটি একটু ধাক্কা দিলাম। ওমা ! দরজা দেখি খোলা। ভিতরে প্রবেশ করলাম। একটি কাগজে লিখা রয়েছে জুতো পায়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ না করার জন্য। জুতো খুলে করিডোরে রাখলাম। কিন্তু আমার ঘর কোথায় ? চিন্তা করতে করতে ড্রয়িং রুমে পরিবেশ করলাম। সব কিছু খুব সুন্দর পরিপাটি। তারপরে আরেকটি করিডোর পাড়িয়ে দেখলাম তিনটি রুম রয়েছে এবং একটি রুমের দরজার ওপর চক দিয়ে আমার নাম ”আরাফাত গাফ্ফার” লিখা রয়েছে। বুঝতে বাকি রইলোনা যে সেটিই আমার রুম। অতঃপর গাড়ি থেকে সব মাল-সামানা নিয়ে আসলাম। লাস্ট যখন আবার প্রবেশ করি তখন মনে মনে চিন্তা করছিলাম যে কি করবো ? দরজা বন্ধ করে দিবো ? নাকি যেমনটা খোলা পেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই রেখে দিবো ? যেহেতু আমি এমন বিষয়ের সাথে অভ্যস্ত নই তাই এমন চিন্তা অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত যেভাবে খোলা পেয়েছিলাম সেভাবে রেখেই ঘুমুতে চলে গেলাম।

সেটি যেহেতু ছিল প্রথম অভিজ্ঞতা তাই একটু অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে বাকি যেই সব স্থানে গিয়েছি সব স্থান দেখার পর বুঝলাম প্রতিটি জায়গাতেই এমন। সবাই সারা রাত দরজা খোলা রেখেই ঘুমায় এবং কেউ বিন্দুমাত্র চিন্তাও করেনা যে খারাপ কিছু ঘটতে পারে।
একটি জাতিকে শাস্তির ভয় না দেখিয়েও কি আইন মান্য করানো সম্ভব ?
আইসল্যান্ডে হয়তো সম্ভম্ব। আপনাদের কে বলেছিলাম যে আমরা দুই রাত গাড়ি তে কাটিয়েছি। সেই দুই রাত আমরা ক্যাম্পিং সাইটে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির ভিতর ঘুমিয়েছি। ক্যাম্পিং সাইট গুলো তে টয়লেট, গোছল খানা, কিচেন এবং ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা থাকে যাতে করে মানুষ তাদের মোবাইল চার্জ দিতে পারে (বিশ্বাস করুন আমি মানুষ কে দেখেছি মোবাইল চার্জে রেখে চলে যেতে). এই ধরণের ক্যাম্পিং গুলো তে যেহেতু এতো ফ্যাসিলিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে সেহেতু সেই বাবদ তাদের একটি ছোট্ট কস্ট রয়েছে। সেখানকার প্রবেশ দ্বারেই লিখা ছিল ক্যাম্প ২৪ ঘন্টা খোলা কিন্তু পেইমেন্ট করা যাবে শুধু মাত্রার অফিস খোলা থাকা কালীন সময়ে। সাধারণত অফিস খোলা থাকে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। এর পরে যদি কেউ আসে তাহলে তারা ক্যাম্পে থাকতে পারবে এবং পেইমেন্ট করবে পরের দিন। এই সব স্থানে সাধারণত মানুষ রাতের দিকেই আসে যখন অফিস বন্ধ থাকে। কেউ ইচ্ছা করলেই ১০ টা বাজার ১০ মিনিট আগে পেইমেন্ট না করেই চলে যেতে পারে কিন্তু কেউই সেটি করেনা। সবাই অপেক্ষা করে অফিস খুলবার জন্য। টাকা পরিশোধ করে তারা চলে যায়।

ইউরোপের বিভিন্ন কার পার্কে পার্কিং করার পর মেশিনের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে হয়। টাকা পরিশোধ করলে মেশিন থেকে একটি টোকেন বের হয় যেই টোকেন গাড়ির ডিসপ্লে তে রাখতে হয়। পার্কিং পেমেন্ট করা হয়েছে কিনা এগুলো চেক করার জন্য আলাদা এজেন্ট থাকে যারা সারাদিন হেটে হেটে কন্ট্রল করে যে পেমেন্ট ছাড়া কোনো গাড়ি পার্কিং করলো কিনা। এমন গাড়ি পেলেই সাথে সাথে জরিমানা। জরিমানাটি গাড়ির গ্লাসের ওপর স্টিকার দিয়ে লাগিয়ে রেখে যায়। আইসল্যান্ডেই আমি প্রথম দেখলাম যেখানে গাড়ির পার্কিং পেইমেন্ট করার মেশিন থাকলেও নেই কোনো চেক করার লোকজন। আপনি ইচ্ছা করলেই পার্কিং পেইমেন্ট না করেই চলে যেতে পারেন ; জরিমানা করার কোনো লোক নেই। কিন্তু তারপরও সবাই সবার দায়িত্ব অনুযায়ী নিজ নিজ দায়িত্বে পার্কিং পেমেন্ট করে থাকে।
আমি একটি প্যাট্রোল স্টেশন থেকে তেল নিয়েছিলাম। আইসল্যান্ডের প্রতিটি প্যাট্রোল স্টেশনে তেল নেয়ার জন্য সেলফ সার্ভিস পেইমেন্ট করতে হয়। মেশিনের ভিতর কার্ড অথবা ক্যাশ টাকা ঢুকাতে হয় তারপর তেল ঢুকাতে হয়। আমি আইসল্যান্ডে কোনো ক্যাশ টাকা নিয়ে যাইনি (যার কারণে কত টাকা এক্সাক্টলি খরচ হয়েছে সেটি এখনো হিসেব করা হয়নি) ; সব পেমেন্ট কার্ডেই করেছি। একবার আমি প্যাট্রোল নিয়ে আমার ক্রেডিট কার্ড টি ভুলবসত মেশিনের মধ্যে রেখেই দোকানের ভিতর গিয়েছিলাম কফি খেতে। কফি খাওয়া মাত্র শুরু করেছি এর মধ্যে একজন লোক ভিতরে এসে চিৎকার করে বলছে ” Is Arafat Gaffar here ??” আমি তো অবাক ! কি হলো আমার নাম এভাবে চিৎকার করে ডাকছে কেন ? আমি উত্তর দিলাম , ”Yeah, I’m Arafat Gaffar. What happened ?” সে বললো , ”you left your credit card in the payment machine”. কথাটি বলে আমার কার্ডটি সে আমাকে তুলে দিলো। ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা ছিলোনা। তারপরও যতটা বিনয়ের সাথে সম্ভব ধন্যবাদ দিলাম। কার্ড টি যদি হারিয়ে যেত তাহলে আমার পুরো ট্রিপটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারতো।
এটাই আইসল্যান্ড এবং সেই দেশের মানুষের সভ্যতা। আমি এই কথা বলছিনা যে তারা পারফেক্ট এবং তাদের কোনো দোষ নেই। তবে তাদের যেই ভালো দিকটি আমি দেখেছি সেই ভালো দেখে আমি অভিভূত এবং তার প্রশংসা না করে আমি থাকতে পারবোনা। প্রথিবীর প্রতিটি জাতিই যদি এতোটা সভ্য হতে পারতো তাহলে পৃথিবী হয়তো আরও সুন্দর হতো।